আগুন লাগার পরও লঞ্চ চলে ৪৫ মিনিট

আগুন ধরে যাওয়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ নদীতীরে তাৎক্ষণিকভাবে ভিড়লে হয়তো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যাওয়ার পর প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট চলার পর আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। আগুনের তীব্র উত্তাপে লঞ্চের স্টিল কাঠামোর আয়তন বেড়ে যাওয়ায় প্রায় দরজা আটকে যায়। ফলে লঞ্চ থেকে অনেকে বেরুতে পারেননি। নদীতেও অনেকে ঝাঁপ দিতে পারেননি। ফলে বদ্ধ উনুনে পুড়ে মরেছে মানুষ।

বৃহস্পতিবার ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর মাঝখানে অগ্নিকাণ্ডকবলিত লঞ্চের বেঁচে যাওয়া একাধিক যাত্রী জানান, লঞ্চটিতে আগুন তীব্র আকার ধারণ করলে এর চালক প্রথমে তীরের দিকে নিয়ে গেলেও পরে আবার মাঝ নদীতে নিয়ে আসেন। কেন তিনি এটা করলেন তা পরিষ্কার নয়।

বরগুনার বামনা উপজেলার বাসিন্দা লঞ্চের যাত্রী রাশেদ জানান, লঞ্চে যাত্রী বোঝাই ছিল। কোথাও জায়গা না পেয়ে আমি ইঞ্জিন রুমের পাশেই ছিলাম। লঞ্চটি রাত ২টার দিকে বরিশাল নদীবন্দর পার হয়। এর ঠিক ২০-২৫ মিনিট পর সুগন্ধ্যা নদীর দপদপিয়া পয়েন্ট পেরুনোর পরপরই ইঞ্জিন রুমের পাশে প্রথম আগুন জ্বলতে দেখি। তখন অবশ্য তা খুব বেশি ছিল না। এ অবস্থাতে লঞ্চ চলতে থাকে। একই সঙ্গে স্টাফরা আগুন নেভানোর চেষ্টা চালাতে থাকেন। এভাবে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট চলার পর হঠাৎ করেই আগুনের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। আগুনে দগ্ধ রাশেদ বর্তমানে বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ইঞ্জিন রুমের পাশেই থাকা চিকিৎসাধীন দগ্ধ আরেক যাত্রী বরগুনার ঢলুয়া এলাকার বাসিন্দা কালু মিয়া বলেন, ইঞ্জিন রুমের পাশেই ছিল সাত ব্যারেল তেল। এক পর্যায়ে সেগুলো বিস্ফোরিত হলে মুহূর্তেই আগুন পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে। এর ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে-তৃতীয়তলার কেবিনে থাকা যাত্রীদের প্রায় কেউই আর বেরুতে পারেননি। মুহূর্তেই পুড়ে তারা কয়লা হয়ে যান।

বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক যাত্রী বরগুনার খোলপেটুয়া গ্রামের আসিফ সিকদার জানান, তীব্র শীতে ঠান্ডা বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে একদিকে যেমন লঞ্চে ঢোকা বেরুনোর সব গেট আটকানো ছিল তেমনি চার পাশের মোটা পর্দাগুলো বেঁধে নামিয়ে রাখা হয়। চোখের পলকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে সবার আগে পুড়তে শুরু করে পর্দাগুলো। তীব্র উত্তাপে লঞ্চের স্টিল কাঠামোর আয়তন বেড়ে যাওয়ায় আটকে যায় প্রায় সব গেট। ফলে লঞ্চের দু’দিক দিয়ে যেমন যাত্রীরা নদীতে ঝাঁপ দিতে পারেননি তেমনি গেট আটকে যাওয়ায় আবার অনেকে বেরুতেও পারেনি। বদ্ধ উনুনে পুড়ে মরেছে মানুষ।

লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী কামরুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার সদর ঘাট থেকে লঞ্চটি ছাড়ার পর থেকেই লঞ্চের ইঞ্জিন থেকে খানিকটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল। নিয়মিত লঞ্চ যাত্রী কামরুলের ভাষায়, ‘শব্দটা ছিল অস্বাভাবিক। সাধারণত লঞ্চে এরকম শব্দ আগে আর কখনো শুনিনি। এভাবে ঢাকা থেকে সুগন্ধা নদীর দপদপিয়া পর্যন্ত আসার পর আগুন জ্বলে ওঠে ইঞ্জিন রুমে। এ সময় লঞ্চ না চালিয়ে চালকসহ লঞ্চের অন্য কর্মকর্তারা তিরে ভিড়িয়ে দিলে হয়তো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। কিন্তু তারা তা না করে আগুন নেভানোর চেষ্টার পাশাপাশি লঞ্চ চালাত থাকেন। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যাত্রীদেরও কিছুই জানানো হয়নি। এরপর যখন বিস্ফোরণ ঘটে তখন আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কারও কিছুই করার ছিল না। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘তৃতীয়তলায় প্রথম শ্রেণির কেবিনের যাত্রীদের অনেকে বোধকরি বেরুতে পারেননি। অনেকে হয়তো পুড়ে মারা গেছেন।’

দুর্ঘটনার পর ঝালকাঠি থেকে ৭০ জনের মতো দগ্ধ নারী-পুরুষ-শিশুকে চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে আসা হয়। তাদের হাত ও পায়ে পোড়া চিহ্ন দেখা গেছে। তাদের একজন বরগুনার বেতাগীর বাসিন্দা হারুন মিস্ত্রি বলেন, ‘আগুন ছড়িয়ে পড়ার পরপরই মুহূর্তের মধ্যে তীব্র উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে লঞ্চের স্টিল কাঠামো। ডেকে যেমন পা রাখা যাচ্ছিল না তেমনি হাত দিয়েও ধরা যাচ্ছিল না কিছুই। ওই অবস্থায়ই জীবন বাঁচাতে হাত-পা পুড়িয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে থাকে মানুষ। মূলত যারা নদীতে ঝাঁপ দিতে পেরেছে তারাই বেঁচে গেছেন।

আগুন লাগার পর লঞ্চ তীরে না ভিড়িয়ে চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সদ্য সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল আহসান বাদল। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘চালকের অদক্ষতা এ ক্ষেত্রে বড় অপরাধ হিসাবে কাজ করেছে। আগুন লাগার পর ঝুঁকি না নিয়ে লঞ্চ থামিয়ে দিলে হয়তো এত বড় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটত না।