আগস্টে উৎপাদন শুরু করবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির জন্য ভারতের ঝাড়খন্ডে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে দেশটির বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি আদানি পাওয়ার। ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ হলে আগামী জুলাই-আগস্ট নাগাদ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট কমিশনিং করা হবে। তবে কমিশনিংয়ের পরই কেন্দ্রটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাবে না বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, এ বিদ্যুৎ দেশে আসতে আরো কিছু সময় লাগবে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিট আগামী বছর জানুয়ারি নাগাদ চালু হতে পারে বলেও জানা গেছে।

বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। আদানির বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে যুক্ত হলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। এতে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট, যা দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশ।

শুরুতে কথা ছিল, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট এবং মে মাসে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে যাবে। পরে সময় বাড়িয়ে প্রথম ইউনিটের উৎপাদনে যাওয়ার সময় হিসেবে জুলাই-আগস্টের কথা বলা হচ্ছে।

মূলত কভিড মহামারীর কারণেই আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যথাসময়ে উৎপাদনে যাওয়ার বিষয়টি বিলম্বিত হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারত ও বাংলাদেশ অংশের গ্রিড লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ও বগুড়ায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের কাজ চলছে। এ উপকেন্দ্রের জন্য চীন থেকে যন্ত্রাংশ আসছে। তবে এক্ষেত্রেও পড়েছে মহামারীর প্রভাব। সম্প্রতি চীনে কভিড সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে আসতে দেরি হচ্ছে। এসব যন্ত্রপাতির দেশে পৌঁছার ওপরই নির্ভর করছে বিদ্যুৎ আমদানি কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎ সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী দুই দেশই দ্রুত কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। দেশেও পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত হওয়ার পর যেন বসে থাকতে না হয়, সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

তবে বিপিডিবির অন্য একটি সূত্র বলছে, জুলাই-আগস্টে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে গেলেও তখনই তা বাংলাদেশে পৌঁছবে না। এজন্য আরো কিছুদিন সময়ের প্রয়োজন। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ বিদ্যুৎ দেশের গ্রিডে যুক্ত হতে পারে। কারণ হিসেবে সূত্রটি জানিয়েছে, আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে আসার জন্য দেশের উত্তরাঞ্চলে যে ধরনের সঞ্চালন অবকাঠামো থাকা প্রয়োজন তা এখনো নির্মাণ করা যায়নি। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এ সঞ্চালন প্রকল্পের কাজ করছে। তবে চীন থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আসতে দেরি হলে ঠিক কবে নাগাদ আদানির বিদ্যুৎ দেশে আসবে তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মূলত উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগের বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসন করার লক্ষ্য থেকেই আদানির বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত্প্রবাহ বাড়ানোও ছিল অন্যতম লক্ষ্য। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাংলাদেশের ডেডিকেটেড একটি সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত হলেও বাকি রয়েছে বড়পুকুরিয়া-বগুড়া ও কালিয়াকৈর সঞ্চালন লাইন। এটির কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পিজিসিবি।

জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের কাজ চলছে। প্রতিটি ইউনিটের সক্ষমতা ৮০০ মেগাওয়াট। এরই মধ্যে প্রথম ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ। এখন প্রথম ইউনিটের কমিশনিং সংক্রান্ত কাজ চলছে। আগামী জুলাই অথবা আগস্টে প্রথম ইউনিট উৎপাদনে যাবে।

বাংলাদেশের জন্য আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ডে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে সেখান থেকে নিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রেও আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত দেশের উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে এ বিদ্যুৎ আমদানি করছে সরকার। আদানির বিদ্যুৎ দেশে আমদানির জন্য এরই মধ্যে ভারত সীমান্তবর্তী মনাকষা থেকে রহনপুর পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করেছে পিজিসিবি।

এছাড়া এ বিদ্যুৎ উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগে সরবরাহের পাশাপাশি জাতীয় গ্রিড লাইনেও যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এজন্য বড়পুকুরিয়া থেকে বগুড়া হয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বৃহৎ লাইন নির্মাণে ৩ হাজার ৩২২ কোটি টাকা ব্যয় করছে পিজিসিবি। তবে এ প্রকল্পে গতি না থাকায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে বলেও আশঙ্কার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন নির্মাণে চার ধাপে কাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনের পাশাপাশি সাবস্টেশন রয়েছে বেশ কয়েকটি। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০২২ সালের জুন নাগাদ এ প্রকল্পের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজের ভৌত অগ্রগতি সাড়ে ১১ শতাংশ এবং আর্থিক কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিজিসিবির এক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটি হাতে নেয়ার পর এর প্রস্তুতিমূলক কাজেই প্রায় এক বছর শেষ হয়ে গেছে। এরপর করোনা মহামারী শুরু হলে প্রকল্পের কাজ থমকে দাঁড়ায়। মূলত প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগেই বিলম্ব হয়েছে বেশি। এছাড়া প্রকল্পের বড় একটি অংশে ভারতীয় অর্থায়ন থাকায় সেখানেও জটিলতা রয়েছে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার জন্য ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতামূলক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। মূলত এ চুক্তির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে ভারত সরকারের সহযোগিতা বাড়ানো। এরই অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে ভারতীয় বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সমঝোতা সই করে বিপিডিবি। এর মাধ্যমে ভারত থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে চুক্তি হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে বিপিডিবির সঙ্গে আদানির বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৫ বছর মেয়াদি এ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারিত হয় ৬ টাকা ৮৯০ পয়সা (৮ দশমিক ৬১২ সেন্ট)। যদিও বৈশ্বিকভাবে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এখন আর এ মূল্যে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিপিডিবি-সংশ্লিষ্টরা।