অর্থকষ্টে ঈদের আনন্দ নেই খুলনার পাটকল শ্রমিকদের

২০২০ সালের ২ জুলাই খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর গেটে কারখানা বন্ধের নোটিস টানানো হয়। ৩ জুলাই সকালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কারখানাগুলো।

যখন কারখানা বন্ধের নোটিস টানানো হয়, তখনো শ্রমিকরা জানতেন, বেসরকারি উদ্যোগে পাটকলগুলো আবার চালু হবে। আগে কাজ করা শ্রমিকরা সেখানে প্রাধান্য পাবেন। সেই আশায়ই শ্রমিকরা পাটকলগুলোর আবাসিক এলাকা ছেড়ে খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। তবে এখন তারা হতাশ।

প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের সর্বশেষ সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, কারখানাগুলো আদৌ আর চালু হবে কিনা, সেটি নিয়েও আমরা এখন সন্দিহান। কাজ হারিয়ে শ্রমিকদের অধিকাংশই এখন বেকার। অর্থকষ্টে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দুদিন বাদেই ঈদ। ঈদে নতুন পোশাক নয়, এসব শ্রমিক পরিবারে একটু সেমাই-চিনির সংস্থানই নেই।

শাহানা আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ২০২০ সালের ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেছিলেন, শ্রমিকদের শতভাগ পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু দুই বছরেও শ্রমিকরা তাদের পাওনা বুঝে পাননি। স্থায়ী শ্রমিকরা পাওনার কিছু অংশ পেলেও অস্থায়ী (বদলি) শ্রমিকরা কোনো টাকাই পাননি। কবে পাবেন, তাও কেউ জানেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) খুলনা অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা জানান, পাটকল বন্ধের পর শ্রমিকদের অর্ধেক টাকা নগদ ও অর্ধেক টাকা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে দেয়ার ঘোষণা দেয় বিজেএমসি।

খুলনাঞ্চলের নয়টি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিক ছিলেন ১৪ হাজার ৯৮৭ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪ জন তাদের পাওনা নগদ প্রায় ৪৩ কোটি টাকা এবং ৯ হাজার ৪৮১ জন শ্রমিক তাদের পাওনা প্রায় ৪৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এখনো পাননি। এছাড়া খুলনার সাতটি পাটকলের ২১ হাজার ৩৫১ জন অস্থায়ী (বদলি) শ্রমিকের পাওনার পরিমাণ ১১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তারাও কেউ এখনো কোনো টাকা পাননি। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত খালিশপুর জুট মিলের ৪ হাজার ৪৭৪ জন ও দৌলতপুর জুট মিলের ৩৫০ জন শ্রমিক দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতেন। কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে তারাও কোনো টাকা পাননি।

অস্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের বিষয়ে তাদের কাছে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি জানিয়ে বিজেএমসির মহাব্যবস্থাপক ও খুলনা আঞ্চলিক সমন্বয়কারী গোলাম রাব্বানী বলেন, খুলনা অঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলের মধ্যে খুলনা নগরের খালিশপুরে চারটি ও ভৈরব নদের অপর পারে দিঘলিয়া উপজেলায় একটি। এছাড়া ফুলতলার আটরা শিল্প এলাকায় দুটি ও যশোরে দুটি। বন্ধ পাটকল ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দুবার দরপত্র আহ্বান করে মাত্র একটি পাটকল (ক্রিসেন্ট) ইজারা দেয়া সম্ভব হয়েছে। অন্য সাতটি (মামলা জটিলতায়) ইজারা দেয়ার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। পাটকল চালু হলে আগে কাজ করা শ্রমিকরাই অগ্রাধিকার পাবেন।

স্থানীয় সিপিবি নেতা এসএ রশিদ বলেন, এসব পাটকলে ৪০ হাজারেরও বেশি স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক কাজ করতেন। কাজ হারিয়ে ওই শ্রমিকদের অধিকাংশই এখন বেকার। পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কারখানা চালুর নিশ্চয়তা না থাকায় এরই মধ্যে খালিশপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন কেউ কেউ। যারা আছেন অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটছে তাদের। দীর্ঘদিন আয়-রোজগারহীন এসব মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও চরম ঝুঁকিতে।

রশিদ বলেন, আশির দশকেও খুলনা শিল্পাঞ্চলে ছিল প্রাণের স্পন্দন। সেনাশাসক এরশাদ ১৯৮৪ সালে প্রথম বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে এ এলাকার কল-কারখানাগুলো বন্ধ করা শুরু করেন, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। একসময়ের কর্মচঞ্চল খালিশপুর এখন প্রায় বিরানভূমি। পাটকলগুলোয় প্রচুর সম্পদ রয়েছে। এগুলো ইজারা বা পিপিপির ভিত্তিতে ছেড়ে দেয়া না হলে এসব সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে।

পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক কুদরত-ই-খুদা বলেন, বিজেএমসি, অর্থ ও পাট মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও ভ্রান্তনীতির কারণে পাটকলগুলোয় লোকসান হয়েছে। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে প্রতিটি সরকারই লোকসান প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে এসব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে।

সরেজমিন খুলনা নগরের খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, চারদিক সুনসান নীরবতা। লোকজনের আনাগোনা নেই তেমন। নেই ঈদের আমেজ। শ্রমিকদের বসবাসের স্থানগুলোও ধ্বংসস্তূপ। বেকারত্ব আর মানসিক অশান্তিতে দুর্বিষহ জীবন কাটছে অধিকাংশ শ্রমিক পরিবারের। এখানকার শ্রমিকদের কেনাকাটার বড় বাজার চিত্রালী। ওই বাজারে ঢুকে দেখা যায়, ঈদের বেচাকেনা তেমন নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের আগমন কম।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের একটি চায়ের দোকানের সামনে কথা হয় ওই কারখানার একসময়ের অস্থায়ী শ্রমিক নাসিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, পাটকল বন্ধের প্রায় দুই বছর হলেও তার পাওনার একটি টাকাও পাননি। অর্থকষ্টে পরিবার নিয়ে জীবন যাপন করছেন। দুদিন বাদেই ঈদ। কীভাবে একটু সেমাই-চিনি কিনবেন তা জানেন না তিনি। একপর্যায়ে চোখের পানি মুছতে থাকেন।

খালিশপুরের প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলে শ্রমিকের কাজ করতেন আজাদুর রহমান। জুট মিলটির কলোনিতেই পরিবার নিয়ে থাকতেন। কারখানা বন্ধ হওয়ার পর পাশেই ঘর ভাড়া নিয়ে আছেন। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় পাটকলে কাজ করেছেন তিনি। এখন অন্য কোনো ভারী কাজ করতে পারেন না। ঈদ দরজায় কড়া নাড়লেও সেমাই-চিনি বা পোশাক কিছুই কিনতে পারেননি এখনো।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের সর্বশেষ সিবিএ সাধারণ সম্পাদক হেমায়েত উদ্দিন আজাদী বলেন, সরকার তিন মাসের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের ঘোষণা দিলেও এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। শ্রমিকদের বেশির ভাগই এখন বেকার। ঈদে একটু সেমাই-চিনির জন্য সাহায্যের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে তাদের।