তিন দেশের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিইপিজেডের মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের ‘এ’ ক্যাটেগরিতে নিবন্ধিত। প্রতিষ্ঠানটি যাত্রার শুরু থেকে বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্যে তাদের অনিয়ম নিয়ে অর্থাৎ ৫৫৫ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির সংবাদ প্রকাশ করেছে গণমাধ্যম। এবার প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ আমদানির মাধ্যমে ১০৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উঠে এসেছে।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের সিইপিজেডের মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড থেকে কর্ণফুলী ইপিজেডে বরাদ্দকৃত প্লটের নির্মাণকাজ শেষ হওয়া না পর্যন্ত কর্ণফুলী ইপিজেডে অবস্থিত তাদের অন্য প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই অ্যাপারেলস লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানে পণ্য সংরক্ষণের জন্য আবেদন করে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট নিরীক্ষা-সংক্রান্ত সব দলিলপত্র দাখিল করে দুই মাসের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হবে এমন শর্তে অনুমোদন দেয় প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী সময় কোনো চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়নি, এমনকি কর্ণফুলী ইপিজেডে মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড নামে কোনো প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেনি।
ফলে বেজপার তথ্য, সিআইএস থেকে আমদানি-রপ্তানির তথ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে রপ্তানিসংশ্লিষ্ট তথ্য গ্রহণ করে তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট। সেই কমিটি চট্টগ্রাম কন্ড কমিশনারেটকে জানায়, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড এবং বাংলাদেশ কাস্টমসের ডেটাবেইজ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পিআরসি ডেটাবেইজ যাচাই করে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ও ২০১৩ সালে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে, তার তুলনায় বেশি পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামাল অবৈধভাবে আমদানি করেছে।
ওই কমিটি বন্ড কমিশনারেটকে আরও জানায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮ সালে ৩৮ হাজার ১০৪ কেজি, ২০০৯ সালে দুই লাখ ৪৯ হাজার ৮৯৮ কেজি, ২০১০ সালে পাঁচ লাখ ১৫ হাজার ৪০৬ কেজি, ২০১১ সালে ছয় লাখ ১৬ হাজার ৬৪১ কেজি ও ২০১৩ সালে ৯ লাখ ৯০ হাজার ৭৯ কেজি পণ্য অবৈধভাবে আমদানি করেছে, যার আমদানি মূল্য ১১৯ কোটি ৫১ লাখ ৬২ হাজার ৩১৭ টাকা এবং এর বিপরীতে ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ হারে শুল্ক আসে ১০৬ কোটি ৭৫ লাখ ১৮ হাজার ৯৮১ টাকা, যার পুরোটাই রাজস্ব ফাঁকি হয়েছে।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি একই সময়ের মধ্যে ৩৮১টি ভুয়া ইএক্সপি’র মাধ্যমে অবৈধভাবে পণ্য অপসারণ করে ৫৫৫ কোটি ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮১ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে, যে বিষয়ে গত ৫ নভেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে শেয়ার বিজ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মেসার্স ওয়ার্ল্ড ই ড্রেস প্যান্টস লিমিটেড অবৈধ আমদানির মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। বন্ড কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির নিকট অসংগতি সম্পর্কে ব্যাখা চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া ইএক্সপি ব্যবহার করে বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালার পালনীয় শর্তাবলি সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে, যা শাস্তিমূলক অপরাধ এবং লাইসেন্স বাতিলযোগ্য। তাই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত জাবাব দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিগত শুনানি চাইলে লিখিত জবাবে উল্লেখ করার জন্য বলা হয়েছে। অন্যথায় সরকারি রাজস্ব সংরক্ষণ ও ন্যায়-বিচারের স্বার্থে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রাজস্ব ফাঁকির মামলাটি একতরফাভাবে নিষ্পত্তি করা হবে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম সিইপিজেডের এফএস-২নং প্লটে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ‘বি’ ক্যাটেগরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরে কোম্পানিটি মালিকানা শেয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে ‘বি’ ক্যাটেগরি থেকে ‘এ’ ক্যাটেগরিতে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে ২০০৪ সালের ১০ নভেম্বর সাময়িকভাবে বন্ড রেজিস্ট্রেশন নং-১৭৩/২০০৪ প্রদান করা হয়।
তারপর ২০০৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটিকে স্থায়ী বন্ড লাইসেন্স প্রদান করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া শুরু করে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি কোনো বার্ষিক নিরীক্ষাও সম্পন্ন করেনি। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট থেকে একাধিকবার চিঠি দিয়েও করানো যায়নি কোন অডিট।
একই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি তথ্য পাঠানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট লিয়েন ব্যাংক থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। ওই ব্যাংক বরাবর একাধিবার চিঠি দিলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি বন্ড কমিশনারেটকে।