অগ্নি বীমা: গ্রাহক ও বীমা কোম্পানীর যে সতর্কতা প্রয়োজন

 

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ:

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋন গ্রহন করলে তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋন গ্রহনকারীকে বাংলাদেশে চালু যে কোন নন-লাইফ বীমা কোম্পানী থেকে বীমা করা বাধ্যতামূলক কিন্তু কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋন না নিয়ে থাকলে তার সম্পদের বীমা করা বাধ্যতামূলক নহে। তবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলে তার সম্পদের বীমা করতে পারে।

অগ্নিকান্ডে ক্ষতি বর্ননাহীন। যা পূর্ব থেকে ধারনা করা যায় না আবার আগুন লাগার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে কিছু করারও সুযোগ থাকে না। নিজে বাঁচার বা সবার সাথে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টাই তখন মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নিয়তিই জানে কে বাঁচবে আর কে বাঁচবে না। এটাই অগ্নিকান্ডের বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় দুর্ঘটনায় ব্যক্তি প্রানে বাচঁবে না সম্পদের নিরাপত্তা দিবে তা ভাবার বিষয়। ব্যক্তির নিজের জীবনের বিষয় জড়িত না থাকলে অবশ্য সম্পদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করতে হবে। বীমা দাবী পাবার চেয়ে আগুনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে সম্পদ বাঁচানো যে কোন ব্যক্তির প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত। তাতে সম্পদের ক্ষতি কম হয় এবং ব্যক্তি ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়।

অগ্নি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ব্যক্তি নিজে ও তাঁর পরিবার, কোন প্রতিষ্ঠান থাকলে প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ব্যাংক, বীমা কোম্পানী সমূহ, যারা সরাসরি অগ্নি বীমার সাথে জড়িত। এই ধরনের দুই চারটা ঘটনা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ব্যাংক-বীমার দেউলিয়াত্বের জন্য যথেষ্ঠ। তাই সংশ্লিষ্ট সকলের বীমাকৃত সম্পদের নিরাপত্তার জন্য যা যা করণীয় তা করতে হবে এখানে অবহেলা বা গাফিলতির কোন সুযোগ নেই।

নন-লাইফ বীমা কোম্পানীগুলোকে শুধু শুধু বীমা করলেই চলবে না। বীমা করার আগে স্বচক্ষে প্রজেক্ট এবং তাঁর আনুষাঙ্গিক সকল দিক দেখে বীমা করতে হবে। সরল বিশ্বস বীমার ভিত্তি হলেও আমাদের দেশে তা কতটুকু কার্যকর বীমা কোম্পানীগুলোকে তা ভেবে দেখতে হবে।

বর্তমানে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বীমা করার ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানী নিজেরা এবং প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষীয় সার্ভেয়ার দ্বারা ‘প্রাক প্রকল্প পরিদর্শন’ করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে বীমা করে থাকে। কিছুটা হলেও আমরা এখন সচেতন হয়েছি। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সচেতন হতে পারিনি। অনেক সময়ই আমরা বীমা ব্যবসার স্বার্থে বীমা গ্রহীতাদের অনৈতিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও বীমা করে থাকি যা অনেক সময় ক্ষতির কারন হয় তা থেকে আমাদের পরিত্রানের চেষ্টা করতে হবে।

বীমা গ্রহীতারা কেবল প্রজেক্ট এর মিল, মেশিনারী, আমদানীকৃত মালামাল বা ষ্টক ওর্য়াকিং প্রসেস, রপ্তানীযোগ্য মজুদমাল বা ফিনিস গুডস্ বয়লার, সাব ষ্টেশন, জেনারেটর ইত্যাদির বীমা করতে আগ্রহী। এর বাইরে কখনো কখনো আসবাবপত্র ফ্র্যাকচার, বৈদুত্যিক এপলাইয়েন্স, মেশিনারী ব্রেক ডাউন ইত্যাদির বীমা ব্যংকের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কথা চিন্তা করে ব্যাংক বীমা গ্রহীতাকে ফোর্স করলে তবেই তা করা সম্ভব হয়। অগ্নিকান্ডের সময় পলিসির সাথে সংযুক্ত বীমাকৃত তালিকা হিসাব করে বীমা দাবী নিরূপনের সুযোগ নেই কারন আগুনে সকল কিছুই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। সে দিক বিবেচনা করে বীমা গ্রহীতাদের সম্পূর্ণ প্রজেক্ট টি বীমা করানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

অগ্নিকান্ডের কারনে শুধু সম্পদ নয় প্রতিষ্ঠানের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়, শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকাতে মালিক বিজনেস্ ইন্টারাপশন এর কারনে স্বাভাবিক মুনাফার পরিবর্তে লোকসানে ডুবে যান। এই সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন একমাত্র বীমা কোম্পানীই তার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সঠিকভাবে পূর্ণাঙ্গ বীমা কভারেজ না থাকলে বীমা কোম্পানীর কোন কিছুই করনীয় থাকে না বরং বীমা দাবী না দেয়ার অপবাদ শুনতে হয়।

 

 

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বীমা গ্রহীতাদের আমাদের সচেতন করে তুলতে হবে। অগ্নি বীমায় বীমা গ্রহীতাদের নৈতিক ঝুঁকি বেশী দৃশ্যমান হয়। তাই বীমা করার ক্ষেত্রে নৈতিক ঝুঁকির দিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠান বা বীমাকৃত বস্তুর বিষয়বস্তু ঠিক মতো ওয়াকেবহাল হয়ে ও দাহ্যবস্তুর প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ক্ষতি নিবারনের ব্যবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সঠিক বীমা করা শুধুমাত্র নিজের আর্থিক নিরাপত্তা নয় বরং সমাজ এবং দেশের সম্পদের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সে দিকে সকলের দৃষ্টি রাখতে হবে।

দেশে সংগঠিত অনেক অগ্নিকান্ডের মাঝে সম্প্রতি বনানী এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডের ফলে সার্বিক আর্থিক ক্ষতির অবস্থা এখনো পুরোপুরিভাবে ওয়াকেবহাল হওয়া যায়নি। এখনো জানি না কতটা প্রতিষ্ঠান কি পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বর্হিভূত ব্যক্তিদের বিনিয়োগই বা কত? অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারন কি ? প্রকৃত জান মালের ক্ষয়-ক্ষতি কি ইত্যাদি ইত্যাদি তথ্য আজো আমাদের অজানা। প্রতিটি অগ্নিকান্ডেই এমন বহুবিধ বিষয় অজানা থেকে যায়।

এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ড নিয়ে সকলেই যখন আতংকিত সেই সময় প্রথম আলোর ২০১৯ এর ২৭শে এপ্রিল সংখ্যায় জনাব আফজাল আহ্মেদ প্রকৌশলী, বৈদ্যুতিক পরামর্শক। বৈদ্যুতিক কারনে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হলে কি করনীয় সে সর্ম্পকে যে আলোকপাত করেছেন তার সাথে একান্ত হয়ে বীমা শিল্পের জন্য সর্তকতামূলক কি ব্যবস্থা গ্রহন করা দরকার, তা শিল্পে কর্মরত থাকায় তা নিয়ে আলোচনা করার তাগিদ অনুভব করছি:

ঢাকা মহানগর নির্মান বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা নকশা প্রনয়ন, যোগ্যতা সম্পন্ন ঠিকাদার দ্বারা ভবন নির্মান, বৈদ্যুতিক বিদ্যায় পারদর্শী পরামর্শক দ্বারা নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ বিদ্যুত প্রবাহ নিশ্চিত করতে বৈদ্যুতিক নকশা, মান-সম্মত বৈদ্যুতিক উপকরন ব্যবহার ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষন, কার্যকর ফায়ার ডিটেকশন ও প্রটেকশন ব্যবস্থা, হাই রাইজ বিল্ডিং-এ হাইড্রেন, স্পিংগলার সিষ্টেম রাখা সর্বপোরি ফায়ার সার্ভিস এর অবাধ যাতায়াতের জন্য প্রশস্থ রাস্তা রাখা ও প্রয়োজনে রিজার্ভ জলধারের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক।

বীমা কেম্পানী হিসাবে আমাদের মনে রাখতে হবে সাধারনতঃ বৈদ্যুতিক কারনে আগুন লাগার জন্য দায়ী দুর্বল নকশা, ইনস্টলেশন, সঠিক মানের তার ও ফিটিংস ব্যবহার না করা অদক্ষ ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার/মিস্ত্রী দ্বারা কাজ করানো, লোড ক্যাপাসিটি সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাব, একই পয়েন্টে একাধিক কালেকশন দেয়া, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক মালামাল ব্যবহার, অনুপযুক্ত ওভারলোড ও শর্টসার্কিট প্রটেকশন ইত্যাদি ইত্যাদি। বীমাকারী হিসাবে আমাদের মনে রাখতে হবে বীমাগ্রহীতাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমরাই পারি প্রাথমিকভাবে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ রক্ষায় সহায়তা করতে।

তাই বীমা পলিসি ইস্যুর আগে আমাদের করনীয়ঃ-

১। যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী সকল ব্যবস্থা মেনে বিল্ডিং তৈরী হয়েছে কিনা ?

২। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বিল্ডিং এর সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা ?

৩। অগ্নিকান্ডের জন্য বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা একটি গুরুর্ত্বপূর্ণ বিষয়, তা যথাযথ লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে কিনা?

৪। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষনের জন্য মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষানমাসিক ও বাৎসরিক রক্ষনাবেক্ষন প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখা ?

৫। লোড ক্যালকুলেশন করে ওভার লোডের সম্ভাবনা থাকলে কিভাবে বাইপাস করে লোড সঠিক রাখা যায় তা নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় কিনা ?

৬। বৈদ্যুতিক তার ও আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র ও ফিটিংস সঠিক মানের কিনা ?

৭। ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রনের জন্য কার্যকর ফায়ার ডিকেশন ও প্রোটেকশন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষন করা।

৮। আগুন লাগার পর নিরাপদে নির্গমনের জন্য ফায়ার ষ্টেয়ার, ফায়ার এক্সিট লাইট, ফায়ার এক্সিট সাইনস্ও প্রেশায়ইজেশন সিষ্টেম ভবনে বিদ্যমান আছে কিনা তা দেখা।

 

 

বৈদ্যুতিক আগুনের কারনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ওভারলোডিং! যখন একই আউটলেট থেকে একাধিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্লাগ ইন করা হয় তখন ওভারলোড হয়ে সার্কিট অত্যধিক তাপ উৎপন্ন করে যা দুর্ঘটনার কারন হতে পারে। এক্সটেনশন কর্ড ব্যবহারের পূর্বে আমাদের জানা উচিত এর অভ্যন্তরিন ওভারলোড প্রটেকশন ব্যবস্থা আছে কিনা ? আমাদের জানা নেই বলে আমরা সচারচর তা দেখি না। লাইট ফিকচারের অনুমোদিত ওয়েটের অধিক ওয়াটের বাল্ব লাগানো হয়েছে কিনা যা আগুন লাগার আরো একটি কারন। বহুদিন যাবৎ ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারও ওয়ারিং আগুন লাগার আরো একটি কারন কিন্তু আমরা তা ভ্রুক্ষেপ করি না। ঘন ঘন লোড শেডিং ও অগ্নিকান্ডের অন্যতম কারন। ঘন ঘন লোড শেডিং এর ফলে দুর্বল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদিতে প্রেসার পড়ে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়।

এখন সময় এসেছে এই সব সাধারন বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবার ও বীমার আগে তা খুঁটিয়ে দেখে বীমা গ্রহীতাকে কার্যকর পরামর্শ দিয়ে ক্ষতি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ নতুন প্রজেক্টর অগ্নিকান্ডের সম্ভাবনা কম থাকার কারনে ৫ বা ১০ বৎসরের জন্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির উপর ২০% বা ৩০% প্রিমিয়াম রেয়াত দেয়ার ঘোষনা দিলে এবং ৫ বা ১০ বৎসরের পুরাতন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের জন্য ৫০% হারে প্রিমিয়াম লোডিং ব্যবস্থা চালু ও মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষানমাসিক, বাৎসরিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি পরীক্ষা ও নতুন সরঞ্জামাদি সংযোজনের প্রতিবেদন প্রজেক্টে রাখা যা যে কেউ প্রয়োজনে দেখতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে বীমাকৃত প্রজেক্টের মালিকও বীমা কোম্পানী সকলেই উপকৃত হবে এবং অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক কম হবে। তাই আমাদের বীমা গ্রহীতাকে সচেতন করতে হবে ও আমাদের অগ্নি বীমা করার আগে সর্তক হতে হবে।

(লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও,
ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড)