বীমা শিক্ষা সচেতনতায় করণীয়

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ :

শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। সরকার বিভিন্নভাবে শিক্ষিত জনশক্তি গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন। একটা লেভেল পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়বার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ শ্রীলঙ্কার প্রাথমিক শিক্ষার হার প্রায় ১০০% যা আমাদের অনুসরণযোগ্য। আবার আমরা যদি বীমা শিক্ষা ও সচেতনতা নিয়ে কথা বলতে চাই ভারত এই ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি সাধিত করেছে যা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের বীমা শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে।

বীমার প্রচার ও প্রসার প্রক্রিয়া কি হবে তা সুনির্দিষ্ট করার সময় এসেছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বীমাকে আধুনিকীরণ করার বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন যেমন: ব্যাংকার এস্যুরেন্স, ব্রোকারেজ হাউজ, সিইওদের মধ্য থেকে বীমা কোম্পানীর উপদেষ্টা নিয়োগ, সকল কোম্পানীর জন্য ump-এর মাধ্যমে ডাটাবেজ তৈরী, বাজারে অতিরিক্ত কমিশন ও অন্যান্য অনিয়ম রোধে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস্ ফার্ম দ্বারা সকল কোম্পানীর অডিট করিয়ে যথাযথ জরিমানা আরোপ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোম্পানী পরিচালনার এবং কোম্পানীর পাঁচস্তর বিশিষ্ট কর্মকর্তাদের চাকুরীর সুরক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যা প্রশংসার দাবীদার।

এই বছরে বীমা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো “বীমা সুরক্ষিত থাকলে, এগিয়ে যাব সবাই মিলে” খুবই চমৎকার ও যুথোপযোগী কথা। এই কথার বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের বীমার মৌলিক বিষয়গুলো নিজেদের জানতে হবে এবং বীমা গ্রহীতা বা সেবা গ্রহণকারীদের জানাতে ও বুঝাতে হবে।

সে জন্য দরকার শিক্ষা ও জানার আগ্রহ এবং প্রচার ও প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। বীমার শিক্ষার অবস্থা আমাদের দেশে যা তা বিবেচনায় নিয়ে নেপোলিয়নের মতো বলতে হয় “আমাকে শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো”। এই কথার সূত্র ধরেই বলতে হয় আমরা কতজন বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত? দেশে ৮১টি বীমা কোম্পানী কাজ করছে তাদের তদারকী করতে কি পরিমান বীমা পেশায় শিক্ষিত পেশাজীবি দরকার, তা ভেবে দেখতে হবে, তা-না হলে কাংখিত ফল পাওয়া যাবে না। সুন্দর স্লোগানটি “বীমা সুরক্ষিত থাকলে এগিয়ে যাব সবাই মিলে” তা কেবল প্রবাদ বাক্য হিসাবেই থাকবে। তা কখনো কাম্য হতে পারে না। বীমা কেন আমাদের সমাজে উপেক্ষিত, অবহেলিত তার কারণ খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিতে হবে।

আমরা বীমা শিক্ষার জন্য তেমন কোন ইনষ্টিটিউট গড়ে তুলতে পারিনি বরং একটি মাত্র সরকারী ইন্স্যুরেন্স একাডেমী তাও আতুর ঘরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। যেখানে বিআইএ থেকে বীমা ডিপ্লোমাধারীরা খোদ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত নয় সেখানে বীমা পেশার অগ্রগতি কিভাবে আশা করা যায়?

আমাদের বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়ই একমাত্র বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও বীমা কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন অন্যান্য সকলেই প্রেষণে আছেন। তাঁরাও যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী যার যার ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা রাখছেন। তাই সম্মিলিতভাবে তাঁদের সকলকেই দেশের একমাত্র বীমা একাডেমীকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেখানকার বীমা ডিগ্রীধারীদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে।

বীমায় কর্মরত সকলের প্রশিক্ষণের উপর জোড় দিতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে বীমা ডিপ্লোমাধারী না হলে উচ্চতর পদে পদোন্নতি না দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে বীমায় কর্মরতদের মধ্যে বীমা শিক্ষার ও প্রশিক্ষন বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রশিক্ষিত পেশাজীবিই পারে পেশার প্রতি সম্মান দেখাতে। পেশার সম্মান বাড়লে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত জনশক্তি এই শিল্পে কাজ করতে আগ্রহী হবে। বর্তমান বীমা শিল্পের অধিকাংশ কর্মীই অন্য কোন পেশায় সম্পৃক্ত না হতে পেরে এই পেশায় যোগদান করেছেন। কেউ কেউ অন্য পেশার পাশাপাশি এই পেশায় কাজ করছেন অর্থাৎ বীমা পেশাটা অপশনাল হিসাবে বেছে নিয়েছেন, এদের দিয়ে আর যাই হউক পেশার উন্নতি হবে না। পেশার মান উন্নয়নে পেশাজীবিদের এগিয়ে আসতে হবে আর অপর দিকে পেশাজীবিদের জীবন জীবিকা নিশ্চিত করতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে আপোষহীন ভূমিকা পালন করতে হবে।

অন্যান্য পেশাজীবিদের মতো আমাদের পেশার লোকজনকেও নিজ পেশায় শিক্ষিত করে তোলতে হবে। যারা নিজের পেশার প্রতি সম্মান দেখায় না অন্যেরা কেন তাঁদের সম্মান দেখাবে। আমাদের নেতিবাচক মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে, অন্যেরা বীমার প্রতি নেতিবাচক কথা বললে তা প্রতিহত করতে হবে। আর এই জন্য আমাদের নিজেদের বীমা সম্পর্কে প্রচুর জানতে হবে এবং অন্যদের জানাতে হবে।

আমাদের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অফিসারদের, বিভিন্ন বীমা কোম্পানীর কর্মকর্তাদের বীমা কি, এর প্রয়োজনীয়তা কি, বীমার সুবিধা অসুবিধা ও বীমা পলিসির কাজ কি? বীমা পলিসি দ্বারা কি কি সুরক্ষিত থাকে তা জানা ও বুঝার জন্য ইনসার্ভিস ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় আমরা অনেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ বীমা পেশায় নিয়োজিত আছি কিন্তু বীমা সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা নেই। এটা একটা পেশার জন্য লজ্জাস্কর বিষয়ও বটে!

বীমা শিক্ষাটা আগে নিজেদের মধ্যে রপ্ত করে সাধারণ জনগনের মধ্যে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। বীমা ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান সকল ক্ষেত্রেই কার্যকর। বীমা পেশায় নিয়োজিত থেকে আমরাই আমাদের ব্যক্তিগত বীমা, পারিবারিক বীমা, স্বাস্থ্য বীমা, গাড়ীর বীমা, প্রতিষ্ঠানের বীমার প্রতি উদাসীন। তাহলে আমরা অন্যদের কিভাবে বীমার প্রতি আকৃষ্ট করবো। তাই বীমা সচেতনতা সর্বপ্রথম আমাদের মধ্যেই শুরু করতে হবে। আমরা সচেতন হলে আমাদের পারিপার্শ্বিক সকলেই সচেতন হবে বা আমরা আমাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে সকলকে সচেতন করতে পারবো। বীমা একটি সার্বজনীন বিষয়। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তা বাস্তাবায়ন করতে হবে।

আমরা বীমা শিল্পের উন্নতির স্বার্থে একচ্যুয়ারীয়াল সাইন্স লেখাপড়ার জন্য সরকারীভাবে অনুদানের মাধ্যমে বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর পরিকল্পনা করছি অথচ বীমার অ ক খ শিক্ষার জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিচ্ছি না। দেশীয় বীমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল না করে বরং নতুন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সকলকে প্রাথমিক জ্ঞান দিয়ে ৮১টি বীমা কোম্পানীর জন্য সার্পোটিং ষ্টাফ তৈরীর পরিকল্পনা কেন করছি না তা বোধগম্য নয়? বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে বিভিন্ন স্তরে নতুন কর্মী নিয়োগ অপেক্ষমান। বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও বীমা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের মধ্য থেকে কর্মী নিয়োগ করা হলে এই শিল্পের জন্য ভালো উদ্যোগ হবে।

শিল্পের স্থায়িত্বের জন্য আমাদের শিল্পের উন্নয়ন প্রেক্ষিত কর্মী তৈরী করতে হবে। এই জন্য বিষয় ভিত্তিক ব্যাচ তৈরী করে দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, বীমা শিক্ষা একাডেমী গঠন ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে ও বীমা কোম্পানীগুলোকে প্রশিক্ষণ ও বীমা শিক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে হবে। প্রশিক্ষিত কর্মী ছাড়া বীমা শিল্প রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হতে থাকবে। শিল্পে যারা কর্মরত আছি তাঁরা কেউ তা মেনে নিতে পারি না। তাই সকলেরই এই ব্যাপারে সোচ্চার হবার সময় এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স ডিপার্টমেন্ট রয়েছে কিন্তু সেখানে বীমার ব্যাপারে খুব বিস্তারিত সিলেবাস নেই। কমপ্রিহেনসিভ বীমার সিলেবাস অর্ন্তভুক্তির জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ দরকার আরো দরকার প্রাথমিক পর্যায় থেকে বীমা শিক্ষার ব্যবস্থা করা যাতে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক অবস্থা থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত বীমা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে ও পরবর্তীতে বীমা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বীমা শিল্পের উন্নয়নে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগাতে পারে।

আমাদের জনগণকে বীমা সম্পর্কে সচেতন করার আরো একটি সহজতম উপায় হলো মিডিয়াকে কাজে লাগানো। মিডিয়া এখন অনেকটা আমাদের দোড়গোড়ায়। প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে আমরা কাজে লাগিয়ে বীমার প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে বীমার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারি। যাতে আপামর জনগণ বীমার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়।

সাধারণ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং বীমা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা বলে বা লিখে বুঝাবার মতো নয়। আমরা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের অভাবে প্রতিটি বীমা কোম্পানীর জন্য দক্ষ ও যোগ্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে পারি না বা অসৎ ও অদক্ষ লোকের ভিড়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোককে কাজে লাগাতে পারছি না। বহু অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোক বর্তমানে বীমা শিল্পে কর্মরত আছেন, তাদের খুঁজে বের করে সঠিক মূল্যায়নের দায়িত্ব বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। এই ব্যাপারে ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের দায়িত্বও কম নয়। তাদের মালিকদের অনৈতিক আবদারও বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে এবং যোগ্য লোক নিয়োগের চর্চা তাদের মধ্যেও থাকতে হবে।

অদক্ষ, অনভিজ্ঞ, অর্ধশিক্ষিত লোকই বীমা শিল্পের ঢাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের অব্যবস্থাপনায় কয়েকটি লাইফ বীমার চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইদানিং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা সত্ত্বেও একটি লাইফ বীমা অবৈধভাবে প্রায় দেড় বৎসর পর্যন্ত একজন মুখ্য নির্বার্হী কর্মকর্তার নিয়োগ বহাল রাখাতে টাঃ ৫,০০,০০০/- (পাঁচ লক্ষ) টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশনা দেয়ার পরও ঐ কোম্পানী তা প্রতিপালন করেনি। এমনকি প্রশাসক নিয়োগের কথা বললেও তাতে কর্ণপাত করেনি। এই অবাঞ্চিত পরিবেশ থেকে বের হবার জন্য কঠোর ব্যবস্থা খোদ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু বীমা শিল্পে কাজ করে ছয় দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন। আজ তার উত্তরসূরী হিসাবে বীমা কোম্পানীর মালিক ও কর্মী হিসাবে সে শিল্পেরই আমরা বারটা বাজাচ্ছি। তা উপরোক্ত ঘটনাই প্রমাণ করে আর এজন্য আমাদের একটু দুঃখবোধও নেই।

তাই আমাদের বঙ্গবন্ধুর পেশার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বীমা শিক্ষার প্রচার, প্রসার ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরীকরতঃ হারিয়ে যাওয়া বীমার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এটা শুধু এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে নয় বরং শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি তৈরীর উদ্যোগ ও তা বাস্তাবায়নের সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমেই সম্ভব।

সময় এখন মুখের ফুলঝুড়ি নয় কাজের মাধ্যমে তা প্রমাণের। আমাদের দেশে সোনার ছেলে কবে হবে যারা কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবে। নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী হিসাবে আমাদের কাউকে না কাউকে এই মহান দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখকঃ মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোঃ লিঃ।