নিউ মার্কেটের অনাকাংক্ষিত ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে

মোঃ রফিকুল ইসলাম :

এক সময় দেশের মানুষের মধ্যে শিক্ষা ছিল কম। ঐ সময় বেশীর ভাগ দোকানদার ছিল অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত। তখন ক্রেতা বা বিক্রেতার মধ্যে বেচা-কেনায় একটা মুধুর সম্পর্ক ছিল। দোকানদারগণ স্বল্প সময় খরিদ্দারকে আপন করে নিতেন। দোকানে ঢুকতেই যার যার ধর্মানুযায়ী সালাম বা নমস্কার বিনিময় করে বসার জন্য অনুরোধ করতেন। তাদের কথায় কেউ বসতেন আবার কেউ না বসেই পছন্দের জিনিস বের করার জন্য দোকানীকে আঙ্গুলের ইশারায় দেখাতেন।

নিউ মার্কেট তথা ঢাকা শহরের বড় বড় শপিং মলে রমজান মাস এলেই বেচা কেনা বেড়ে যায় ফলে তাদের লোকের প্রয়োজন হয়। তাই ঐ সকল শপিং মলে অনেক ছাত্র/ছাত্রী খন্ডকালীন জব করে তাদের হাত খরচ চালিয়ে থাকে। এমনও দেখা যায় অনেক ছাত্র ছাত্রী তাদের পিতা মাতা এবং ছোট ছোট ভাইবোনদের শপিং করেন এই সকল শপিং মলে কাজ করে। অতএব ব্যবসায়ি এবং ছাত্র ছাত্রীরা ভাই বোন সম্পর্ক। তাদের মধ্যে অনকাংক্ষিত ঘটনা পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে সেই দিকে নজর রাখতে হবে।

দোকানীদের কাছে যেমন ক্রেতাদের সম্মান ছিল আবার বিক্রেতাদের কাছেও সম্মান ছিল। ক্রেতা বিক্রেতা ভাই ভাই মধুর সুলভ আচরণ ছিল। কোন কোন দোকাদার সম্মান দেখাতে গিয়ে কোন কোন ক্রেতাকে কোক বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। আজ তার পরিবর্তে আমরা কি পাচ্ছি।

ক্রেতা ও বিক্রেতার একটি সংক্ষিপ্ত সংলাপ উপস্থাপন করা হলো:

ক্রেতাঃ ভাই শার্টটার দাম কত?
বিক্রেতাঃ নেন ভাই। অনেক ভালো কাপড়।
ক্রেতাঃ দাম কেমন পড়বে?
বিক্রেতাঃ একদম আনকমন মাল। কোথাও খুঁজে পাবেন না।
ক্রেতাঃ দামটা বলেন আগে।
বিক্রেতাঃ এই নেন বোতাম ছাড়িয়ে দিলাম। গায়ে দিয়ে দেখেন।
ক্রেতাঃ দাম বলেন। তারপর পড়বো।
বিক্রেতাঃ পড়েন। দেখেন, একদম ফিটিংস হবে।
ক্রেতাঃ সবই ঠিক আছে। দামটা বলেন না?
বিক্রেতাঃ ভাই, দামাদামি করবো না। একটা দাম বলে দেবো যদি ভালো লাগে নিবেন না হয় রেখে যাবেন।
ক্রেতাঃ জী বলুন।
বিক্রেতাঃ শুধু শার্টই নিবেন না আরও কিছু? এই ভাইরে প্যান্ট দেখা তো।
ক্রেতাঃ না ভাই, আপনি শুধু এই শার্টটার দামই বলেন।
বিক্রেতাঃ শার্ট কী একটাই? না আরেকটা দিবো?
ক্রেতাঃ না, এটার দাম বলেন।
বিক্রেতাঃ একদাম পরবে ১৮০০ টাকা।
ক্রেতাঃ বলেন কী? এই শার্ট ১৮০০?
বিক্রেতাঃ কেন ভাই? অসম্ভব কি হলো? বেশি বলছি?
ক্রেতাঃ না ভাই লাগবে না।
বিক্রেতাঃ আরে ভাই শুনেন। কত দিবেন?
ক্রেতাঃ না ভাই, আমার এতোটাকা বাজেট নাই।
বিক্রেতাঃ ওই মিয়া ফাজলামো করেন?
ক্রেতাঃ বাজেট নাই তো মার্কেটে আইছেন কিল্লেগা। আমরা কী মস্করা দোকান খুইলা বইছি?
বিক্রেতাঃ ঠিক আছে থাকেন।
ক্রেতাঃ থাকেন কী? শার্টের দাম বলেন।
বিক্রেতাঃ এতো টাকার শার্ট কেনা সম্ভব না।
ক্রেতাঃ সম্ভব না, তাহলে এতো সময় নষ্ট করলেন কেন?
বিক্রেতাঃ আমি তো প্রথমেই বলেছি দাম কত? আপনিই তো প্যাচাইলেন।
ক্রেতাঃ আমার তো কাস্টমারের অভাব। আপনার লগে প্যাচাপেচি করুম।
বিক্রেতাঃ স্যরি ভাই। আমার লাগবে না। আমি যাচ্ছি।
ক্রেতাঃ কিয়ের যাচ্ছি? দাম বলতে অইবো।
বিক্রেতাঃ আসলে আমি একটু কমের মধ্যে নিতে চাচ্ছি।
ক্রেতাঃ কত কম? বলেন শুনি।
বিক্রেতাঃ এই মনে করেন ৩০০-৩৫০ এর মধ্যে।
ক্রেতাঃ এই দামে কিনতে হলে রাস্তায় ভ্যান আছে না? ওই ভ্যান থেকে নিবেন। মার্কেটে ঢুকবেন না।
বিক্রেতাঃ ঠিকাছে।
ক্রেতাঃ ওই মিয়া কই যান? এদিকে আয়েন। একটু বাড়ায়েবুড়ায়ে বলেন। শার্টটা নিয়ে যান।
বিক্রেতাঃ বললাম তো আমার বাজেট কম।
ক্রেতাঃ আচ্ছা, ১৫০০ না একদম ১০০০ দেন। ওই প্যাকেট করে দে।
বিক্রেতাঃ না ভাই, পারবো না।
ক্রেতাঃ পারবেন কত? হেইডা বলেন।
বিক্রেতাঃ ৩৫০ হলে নিবো।
ক্রেতাঃ এই শার্ট ৫০০ টাকায় কোনোদিন কিনতে দেখছেন?
বিক্রেতাঃ দেখি নাই। রেখে দেন।
ক্রেতাঃ দাড়ান মিয়া। ৭০০ হলে পারবেন?
বিক্রেতাঃ বললাম তো বাজেট নেই।
ক্রেতাঃ নেন লাভ করনের দরকার নাই ৫০০ টাকাই দিলাম। ৫০০ টাকার একটা শার্ট পইড়া দেখেন।
বিক্রেতাঃ না ভাই, আমি যে দাম বললাম ওইটা হলে পারবো।
ক্রেতাঃ ওই মিয়া যান কেন? এদিক আয়েন। সেই এক দাম বইলা দাঁড়ায়ে আছেন। আরেকটু আগান।
বিক্রেতাঃ আমি হাইয়েস্ট ৪০০ দিতে পারবো। এর বেশী না। ভালো থাকেন।
ক্রেতাঃ রাগ কইরেন না। এদিক আয়েন। দেন ৪০০ টাকাই দ্যান। ওই বাইরে প্যাকেট কইরা দে।(সংলাপটি সংগৃহীত)

এভাবেই দিনের পর দিন কাস্টমারদের জিম্মি করে ব্যবসা করছে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষ লজ্জা ভয়ে প্রতিবাদ করে না। নিরবে মুখ বুঝে সহ্য করে চলে যান। আরা যারা অন্যায় অনিয়ম মানতে পারেন না তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আজ নিউমার্কেটে প্রতিবাদী ঝড়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আজকাল আমাদের দেশে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত। এমনও দেখা যায় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা শেষ করে নিজ উদ্যোগে ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। যাদের স্বল্প পুজিঁ তারা ছোট ব্যবসা দিয়ে শুরু করেন। একটা সময় দেখা যায় তাদের অনেকেই বড় বড় ব্যবসায়ী হয়ে যান। সুতরাং কোন মানুষকেই ছোট করে দেখা যাবে না। কবির ভাষায় “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে”। তাই কার কখন ভাগ্যের পরিবর্তন হয় তা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা ভালো জানে। কারণ সম্পদ তাঁর(আল্লাহর) হাতে। তিনি যার কাজ পছন্দ করেন তাকেই এই পৃথিবীতে কিছু না কিছু দিয়ে থাকেন।

মানুষ দিন দিন যত শিক্ষিত হচ্ছে ততই সমাজে দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবার কাছেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এর কারণ কি? আমি যতটুকু বুঝতে পারছি আজ সমাজে যেমন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার তার সাথে সাথে মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সম্পদ কিন্তু সীমিত। সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। সম্পদের শুধুমাত্র হাত বদল হচ্ছে। একই সমাজের কেউ বিক্রি করছেন, আবার কেউ ক্রয় করছেন, এভাবেই ঘূর্ণায়মান। তাই সম্পদ আহরণের জন্যই একে অপরের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ করে থাকে।

ইসলামে এটা গ্রহণীয় নয়। তদুপরি আমরা অহরহ করে থাকি। আমাদের মনের অজান্তে আমরা কত গুনাহের কাজ করি তার হিসাব কি আমরা রাখি, নিশ্চয় রাখি না। গায়ের জোরে না বুঝে যখন তখন কিছু অন্যায় করে ফেলি। কারো সাথে না কারো ভুল বোঝাবোঝির কারণে অনেক কিছু ঘটে যায়। যার হিসাব কি আমরা কখন করি?

ইসলাম বলে থাকে কারো দোষ ত্রুটি গোপন রাখলে কাল কিয়ামতের দিনে আল্লাহ ঐ ব্যক্তির দোষ ত্রুটি গোপন রাখবেন। ইসলামে এটাও বলা আছে কারো প্রতি কোন রকম কিছু নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি পরিলক্ষিত হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন ঐ ব্যক্তির সাথে একান্তভাবে বসে পরামর্শ করে ঐ সকল সমস্যার সমাধান করা।

আজকে সামান্য ভুল বুঝার কারণে নিউ মার্কেটে যে অঘটন ঘটে গেল তা কারোই কাম্য নয়। কিন্তু সামান্য ভুল বুঝে একে অপরের সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে তরতাজা প্রান হারিয়ে ফেলিছি। হারিয়ে ফেলিছি কত শত কোটি টাকার ব্যবসা। এছাড়া মানুষের দুর্ভোগের কথা না-ই বললাম। তাই কোন কিছু না বুঝে না শুনে এরকম যেন না ঘটে তার প্রতি সবার সুদৃষ্টি রাখতে হবে।

এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো প্রতিটি মানুষের মধ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়া। ইসলাম শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আর একটা বিষয় সবার জানা তদুপরি বলতে হচ্ছে সেটা হলো আমাদের গ্রামে বা মহল্লায় কখন কোন মন্ত্রী. এম.পি বা সরকারের কোন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার আগমন ঘটে তাহলে দেখা যায় ঐ সকল সমাবেশে মানুষের যোগদান বেড়ে যায়। যখনই কোন মন্ত্রী বা এম.পি সাহেব ডায়েচে উঠে বক্তব্য রাখেন তখন আমরা কেউ কেউ একে অপরের সাথে কথা বলি। এমনও দেখা যায় কেউ কেউ বাদাম কিনে খাচ্ছি। আবার কেউ কেউ বিড়ি, সিগারেটে নেশা করছে।

আমাদের সমাজে প্রতি শুক্রবার বাদ জুম্মার নামাজের পূর্বে মাওলানা বা মুফতি সাহেব মসজিদের মিম্বায় বসে যে সকল বয়ান করেন তখন দেখা যায় কোন মুসুল্লি কারো সাথে কথাতো দূরে থাক তাকায়ও না। সকল সসয় মন দিয়ে হুজুর সাহেবের কথাগুলো শুনেন।

পরবর্তী সময় বাহিরে এসে অন্ততঃ কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়। তাই আমার পরামর্শ মসজিদে বসে হুজুর সাহব যখন বয়ান করেন তখন যেন সম্পদ আহরনের উপর কোরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ান দেন। পরের সম্পদ জোরজবরদস্তি ভোগ করলে কি হবে, ওজনে কম দিলে কি হবে, বেচাকেনায় কতটুকু করনীয় তার উপর বিশদ আলোচনা করলে মানুষ উপকৃত হবে, সমাজে পরিবর্তন আসবে। তাই আসুন আমরা সবাই কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিজের জীবন গড়ি এবং অপরের জীবন গড়ার উপদেশ দেই।

মার্কেটের দোকানীরা সারা বছর কম বেশী যা-ই আয় করেছে এই ঈদের বাজারে তাদের আয় করার একটা মক্ষম সময়। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে সামান্য একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে যে অঘটনা ঘটিয়েছে তাতে তরতাজা মানুষের প্রাণের দায় কে নিবে? আবার বাজারের মানুষের যে ক্ষতি হলো তার দায় ভার কার উপর বর্তাবে।

পরিশেষে বলতে হয় আমরা ইসলামের পথ থেকে যতই সরে যাবো আমাদের মধ্যে ততোই খারাপি কাজ পরিলক্ষিত হবে। আসুন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে ইসলামের আলোকে জীবন গড়ার তাগিদ দেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝবার এবং পালন করার শক্তি দিন । আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে হেদায়েত দান করেন। আমিন।

লেখকঃ মোঃ রফিকুল ইসলাম, একান্ত সচিব, সিইও এন্ড চেয়ারম্যান, ইসলামী কমার্শিয়াল ইসলামী কোম্পানী লিমটেড। ঢাকা, বাংলাদেশ।