ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার কমতে শুরু করেছে। অর্থবছরের প্রথম মাসে দুই হাজার ১০৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। তবে আগের বছরের একই সময় (জুলাইয়ে) তিন হাজার ৪০৮ কোটি টাকা সরকারের নিট ঋণ এসেছিল সঞ্চয়পত্র থেকে। সরকারি নানা বিধিনিষেধ ও করোনার প্রভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই শেষে মোট জমার পরিমাণ পাঁচ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে তিন হাজার ২৬১ কোটি টাকা। মূল ও মুনাফার খরচ বাদ দিয়ে জুলাই শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১০৪ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকঋণ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ করে থাকে সরকার। তবে সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা দেয় সরকার। প্রতি মাসের বিক্রি থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর নিট ঋণ হিসাব হয়। এ অর্থ সরকার রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়।
সাধারণত বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার দুই উৎসের আশ্রয় নিয়ে থাকে; বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ উৎস। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমিয়ে বৈদেশিক উৎসের প্রতি নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে এবার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা।
বিদায়ী অর্থবছরে (২০২০-২১) সরকার আগের অর্থবছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি ঋণ নিয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে নিট প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর আগে কোনো বছরে এত বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি। সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হওয়ার কারণে সরকারের ওপর দায় বাড়ছে। এজন্য সরকার কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর জন্য নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে। অন্যদিকে দেড় বছর ধরে দেশে করোনার প্রকোপ চলছে। এমন পরিস্থিতিতেও প্রতি মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে।
আগের অর্থবছরগুলোর হিসাব দেখলে দেখা যায়, এর আগে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ৯০ হাজার ৩৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হয়েছিল ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকার, যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকার।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত অর্থবছরের সর্বশেষ মাস জুনে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল চার হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। মে মাসে ছিল দুই হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, এপ্রিল মাসে যা ছিল এক হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। এর আগে মার্চ মাসে নিট ঋণ এসেছিল তিন হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তিন হাজার ৬০৯ কোটি, জানুয়ারিতে পাঁচ হাজার ২১৫ কোটি, ডিসেম্বরে এক হাজার ৪৪২ কোটি, নভেম্বরে তিন হাজার ৪০২ কোটি, অক্টোবরে চার হাজার ৩৪ কোটি, সেপ্টেম্বর মাসে চার হাজার ১৫২ কোটি, আগস্টে তিন হাজার ৭৪৬ কোটি ও অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তিন হাজার ৪০৮ কোটি টাকা নিট ঋণ এসেছিল সঞ্চয়পত্র থেকে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। বিক্রির ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এর বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার আগের মতো থাকবে। তবে পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে মুনাফার হার হবে সাড়ে ৯ শতাংশ। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যাবে ৯ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে এত দিন ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যেত। এখন এই সঞ্চয়পত্রে যারা ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে এই হার হবে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই হার সাড়ে ৯ শতাংশ। ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের বর্তমান মুনাফার হার ১১ দশমিক ২০ থেকে কমিয়ে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আর ৩০ লাখের বেশি বিনিয়োগে মুনাফা পাওয়া যাবে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এছাড়া বিনিয়োগ ৫০ লাখের বেশি হলে আট দশমিক ৪০ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যাবে।