রুচির দুর্ভিক্ষ ও হিরো আলম...
আর্য-ব্রাম্মন্যবাদী ধর্মের পৃষ্টপোষক হচ্ছি কেন?

আবুল কালাম আজাদ :

নাট্যকার মামুনুর রশিদের একটি মন্তব্য নিয়ে সারাদেশে রীতিমতো তুলকালাম কান্ড ঘটে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নামকরা ব্যক্তিত্ব জনাব মামুনুর রশিদ মন্তব্য করেন যে, আমরা একটি রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান যেমনি কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যাও।

জনাব মামুনুর রশিদের এ উপলব্দিকে স্বাগত জানালেও দেশ, মাটি আর মানুষের মূল সাংস্কৃতিক বলয় থেকে বেরিয়ে আর্য-ব্রাম্মন্যবাদীদের ধার করা সংস্কৃতির মুল যে গভীরে প্রোতিথ হয়নি, দেশের মানুষ যে সে সংস্কৃতি গ্রহন করেনি তা বুঝতে দেরী করে ফেলেছেন।তিনি কি পারবেন ওনার বলয়ের সংস্কৃতির দেয়াল ভেঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতির দেয়াল মেরামতে হাত দিতে?

আমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইতিহাস অনেক পুরনো।খৃষ্টপূর্ব ছয়শত বছর আগে হরপ্পা আর মোহেন্জোদারো সভ্যতা ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির আদিরুপ। খৃষ্টপূর্ব এক থেকে দেড় হাজার বছর আগে আর্যরা এদেশে আগমন করে পর্যায়ক্রমে ভারতবর্ষ অধিকার করে,কিন্তু বঙ্গদেশ দখল করতে পারেনি। দ্রাবিড় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আঁকডে ধরে আর্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।আর্যরাই ব্রাম্মন্যবাদী আগ্রাসী শক্তি।

৮আগষ্ট ১৯৮৬ সালে দৈনিক ইনকিলাবে আসকার ইবনে সাইকের প্রবন্ধ ‘বাংলার আর্যীকরন’ এ লিখেছেন,” বঙ্গ-দ্রাবিড়দেরকে সন্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করা সম্ভব ছিলনা। আর্যরা তাই এখানে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। আর্যরা করতোয়া নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত এসে বুঝতে পেরেছিলো যে করতোয়ার পূর্ব তীরে অপেক্ষমান বাংগালির বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে তাদের দেশটা দখল করা সম্ভবপর নয়। আর্যদের সমরাভিযান থেমে গিয়েছিল সেখানেই।কিন্তু কালক্রমে বাংগালীদের দেশে সুদীর্ঘকাল ব্যাপী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিযান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছিলো তারা। সে বিজয় ধর্মীয়-কৃষ্টি-সাংস্কৃতিক-সভ্যতার বিজয়। এ বিজয়ের পরে বাদবাকী আর দেশ বিজয়ের কিছু অবশিষ্ট ছিলনা। আর্যরা বাংলা বিজয় সম্পন্ন করেছিল-এ পথেই”।
অষ্টম ও নবম শতকে বাংলায় পাল বংশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরাজয়ের কারন বর্ননা করতে গিয়ে ডক্টর নিহাররন্জন রায় ‘বাংগালির ইতিহাস’ বইয়ের ১৩৯-৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “পাল রাজাদের অনেকেই ব্রাম্মন রাজ পরিবারের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। ফলে বৌদ্ধ ও ব্রাম্মন্য ধর্মের মধ্যে একটা পারস্পরিক সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিলো। বৌদ্ধ দেবালয়ে ব্রাম্মন্য মুর্তি আর ব্রাম্মন্য দেবালয়ে বৌদ্ধ প্রতিমা স্হান পাচ্ছিলো। মিল-সমন্বয়ের এ ধারাকে সকল বৌদ্ধ একভাবে গ্রহন করেনি।সহজযানী আদর্শে বিশ্বাসী বৌদ্ধগন সমন্বয়ের নামে বৌদ্ধ ধর্ম বিলোপের ব্রাম্মন্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।তারপরও পরগাছা বুদ্ধিজীবিদের অদূরদর্শি কর্মকান্ডে গুপ্ত আমলে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আগ্রাসন পাল আমলে পূর্নতা পায়”। তথাকথিত এ সমন্বয় বৌদ্ধ ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিপর্য়য়ের কারন হয়েছিল।

বাংলাদেশে ১৯৫২ সাল থেকে আর্য-ব্রাম্মন্য ধারার পরগাছা বুদ্ধিজীবি শ্রেনীর অপ-তৎপরতা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিন্দু সংস্কৃতির একটা আবহ তৈরী করার প্রয়াস পায়। একটা ধামাধরা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সৃস্টি করতে সক্ষমও হয়। অপ-রাজনীতির চত্র-ছায়ায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বীকার একটা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজকে তাদের অনুসারী বানাতে সক্ষম হয়। তারপরও এদেশের আদি সংস্কৃতির আদি ধারার মূল উৎপাটন করতে সক্ষম হয়নি। তারই বহিঃপ্রকাশ হিরো আলম ও অন্যান্যরা। দেশের আপামর জনগন জনাব মামুনুর রশিদ গংদের সংস্কৃতিকে গ্রহন করেনি, করবেওনা।

রাস্ট্রের ভৌগলিক সীমানা পাহারা দেয়ার পাশাপাশি জাতির সাংস্কৃতিক সীমানা হেফাজত করতে না পারলে জাতি বা রাষ্ট্রের পরিনতি যে কত মারাত্বক হতে পারে পাল বংশ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। অনেক বছর পরে সম্রাট আকবর তথাকথিত ধর্মীয় সমন্বয়ের নামে ধর্ম ও সংস্কৃতিতে অদ্ভুত জগাখিচুডি সৃস্টি করেছিলেন।ইসলামের মৌলিক অনুশাসনের আলোকে মুজাদ্দেদে আলফেসানী সে বিপর্যয় কাটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। আমাদের কাছেওতো ইসলামের মৌলিক অনুশাসনগুলো অক্ষত অবস্হায় আছে। তাহলে আমরা ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’তথাকথিত ধর্মীয় সমন্বয়ের এ শ্লোগানের নামে আর্য-ব্রাম্মন্যবাদী ধর্মের পৃষ্টপোষক হচ্ছি কেন?

 

আবুল কালাম আজাদ :